আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে প্রথম প্রতিবাদী শিক্ষক গ্রেপ্তারে বিক্ষুব্ধ রংপুর
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বিচার দাবিতে সোচ্চার থাকা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মোহা. মাহমুদুল হককে সৃজিত মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই শিক্ষক ও গবেষককে নিঃশর্ত মুক্তির জোর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক শিক্ষার্থী সহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেলে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীন হাজিরহাট থানায় রুজু করা মামলায় নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ফলে শুক্রবার (২০ জুন) জুম্মার নামাজের পরে মানববন্ধনের ডাক দেন তারা। মানববন্ধনে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন।
এসময় রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিকুল ইসলাম বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের পবিত্র চেতনার উপর ভর করে কিছু নরপিশাচ মেতেছে তাদের নৃশংসতায়। ২ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন এক ব্যক্তি অথচ ১০ মাস পর করা হলো হত্যা মামলা। বাদী জানেন না কোন কাগজে সই করেছেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ ৫৪ জনকে আসামি করা হয়েছে এই মেটিকুলাস হত্যা মামলায়। ৫৪তম আসামি করা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহামুদুল হককে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদবী গোপন করা হয়েছে জনাব মাহামুদুল হকের ঠিকানায়। ৫৪ জনের মধ্যে কেবলমাত্র মাহামুদুল হককে গ্ৰেফতার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কোর্টে চালান দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনা কাদের চাহিদা পূরণ করেছে? এই মেটিকুলাস ডিজাইন যে বা যারা করেছে তাদেরকে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, মাহমুদুল হক জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ফেসবুকে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও কোটা সংস্কারের আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার অবস্থান নিয়েছিলেন। আন্দোলনের পক্ষের শক্তিকে মিথ্যা, ভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
জানা যায়, গত বছরের জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে শিক্ষক মাহমুদুল হক আন্দোলনের পক্ষে এবং আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। ২০২৪ সালের ১১, ১৭ ও ১৮ জুলাই তার ফেসবুক পোস্টগুলোতে তিনি আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরার পাশাপাশি আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
১১ জুলাই তার স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের আংশিক রায় অনুযায়ী সরকার চাইলে কোটা কমাতে বা বাড়াতে পারে এবং কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধাক্রম অনুযায়ী শুন্যপদ পূরণ করা যাবে। শিক্ষার্থীদের দাবি সঙ্গত এবং এই রায়ের আলোকে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।’
১৭ জুলাই আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই শিক্ষক। তিবি বলেন, ‘পুলিশ গুলি করলো আমার শিক্ষার্থীকে তার ক্যাম্পাসের মাটিতে দাঁড়িয়ে। পুলিশ এতো সাহস কোথা থেকে পেলো? পুলিশ কি ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি দেখাতে পারবে? অনুমতি পেলেই কি গুলি চালাতে পারে?’
তিনি আবেগঘন ভাষায় লেখেন, ‘আমি পরাহত, আমি অনুতপ্ত এজন্য যে নিজ হাতে বন্দুকের নল চেপে ধরতে পারিনি কারণ আমি তখন ঢাকা থেকে রওনা দিচ্ছিলাম। ক্ষমা করো আমাকে।’ তিনি এই হত্যাকাণ্ডকে ‘নির্বিচার হত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
১৮ জুলাই আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘পুলিশের তদন্ত মানি না, বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।’ তিনি পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে লেখেন, ‘পুলিশের অপরাধের তদন্ত করবে পুলিশ? এটা সাঈদের রক্তের সঙ্গেও প্রহসন। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখলেই স্পষ্ট যে এটি ঠান্ডা মাথায় গুলি চালানো হত্যাকাণ্ড।’ তার মতে, এই হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত একমাত্র বিচার বিভাগীয় মাধ্যমেই সম্ভব।
এই প্রসঙ্গে ২৪-এর ছাত্র আন্দোলনে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, ‘আমার শিক্ষক মোহা. মাহমুদুল হক কেবল একজন শিক্ষকই নন, বরং সাংবাদিকতার জগতে সুপরিচিত নাম। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য, ডেইলি স্টারের অভিজ্ঞ সাংবাদিক, ইউএনবি’র সাব-এডিটর ছিলেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আজ যে মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা একেবারেই হয়রানিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাকে বিকেল ৩:৩০ মিনিটে আটক করে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।’
সোহাগ আরও অভিযোগ করেন, ‘৫ আগস্টের ঘটনার পর এটি তৃতীয়বার মাহমুদুল হককে সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত করা হলো, অথচ প্রতিবারই তার সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ নেই। সাঈদ হত্যাকাণ্ডের পর তিনিই ছিলেন প্রথম শিক্ষক যিনি নির্ভয়ে বিচার দাবি করেন এবং পুলিশের আত্মপক্ষ সমর্থনের পরিবর্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি জানান।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সরব ছিলেন। সাবেক উপাচার্য ড. কলিমুল্লার অনিয়মের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার মুখ খোলাই আজ তার কাল হয়েছে।’
এদিকে শিক্ষার্থী রিনা মুর্মু তার ফেসবুক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ‘প্রহসনের মামলা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় গ্রেফতার মাহমুদুল স্যারকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘এই মামলাটি প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্রমূলক। যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে, সেই জন্য মামলাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের তাজহাট থানায় না করে হাজিরহাট থানায় করা হয়েছে এবং ছুটির দিন বেছে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হাজী নাছির উদ্দিন জানান, মূল ঘটনা হচ্ছে গত ২ আগস্ট কয়েকজন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য তার বাসা ঘেরাও করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি পালিয়ে যান। ওই সময় মুদি দোকানদার সমেস উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তিনি বলেন, তাকে (সমেস)কে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে আসেনি। পুলিশ এসেছিল আমাকে গ্রেপ্তার করতে। হার্ট অ্যাটাকের রোগী কীভাবে জাতীয় বীর হয়? সে কীভাবে সরকার থেকে জুলাই আন্দোলনে শহিদ বলে দুই দফায় ১৫ লাখ টাকা পায়? পুরো ঘটনা সাজানো। এ ঘটনাকে হত্যা মামলা হিসেবে দায়ের করা অন্যায়! নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে!
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু জানান, সমেস উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। একজন হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া ব্যক্তি কীভাবে জাতীয় বীর হয়-আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এ ঘটনায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নালসহ স্থানীয় নিরীহ ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করা সত্যিই দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, সমেস উদ্দিনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কই? ১০ মাস পর মামলা করা হলো এখনও লাশ উত্তোলন করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? পুরো ঘটনা তদন্ত করা উচিত।
সমেস উদ্দিনের জানাজায় ইমামতি করা স্থানীয় মসজিদের ইমাম মমিনুল ইসলাম বলেন, নিহতের শরীরে কোনো জখম দেখিনি। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার কথা শুনেছি। হত্যা করার কথা শুনি নাই।
মামলার এজাহারে বলা হয়, “২০২৪ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন পুলিশ, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নগরীর ১২নং ওয়ার্ডের রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার মুদি দোকানি ছমেস উদ্দিনকে তার দোকানে এসে হুমকি দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছমেস উদ্দিনকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ ও আসামিরা তাকে রেখে পালিয়ে যান। পরে পরিবারের সদস্যরা ছমেস উদ্দিনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঐ এজাহারে বাদী সমেস উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম অভিযোগ, তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করার নির্দেশ দিলে রংপুরের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গসংগঠনের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা গত বছরের ২ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুদিদোকানের সামনে গিয়ে সমেস উদ্দিনকে নেমে আসতে বলে। এ সময় সমেস উদ্দিন টের পেয়ে দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন। আসামিরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার ওপর হামলা চালিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সমেস উদ্দিন গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লে স্থানীয় পুলিশ ও আসামিরা তাকে ঘটনাস্থলে রেখে পালিয়ে যায়।”
এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী সমেস উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগমের বাড়িতে গেলে তিনি জানান, তার স্বামী সমেস উদ্দিনকে ধরতে গত ২ আগস্ট পুলিশ এলে তিনি দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে একপর্যায়ে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারান। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। কেন হত্যা মামলা করলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, প্রশাসন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কাগজে সই করতে বলেছে, তিনি সই করেছেন। তিনি কারও নামে হত্যা মামলা করেননি বলে জানান।
/আশফাকুর রহমান